বয়ঃসন্ধির সময় কৈশোর তারুণ্যের সুখের সৌধ

কৈশোর তারুণ্যের সুখের সৌধ – বিষয় নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি “শিশুর মন ও শিক্ষা” সিরিজের “বয়ঃসন্ধি সমস্যা ” বিভাগের একটি পাঠ।

 

বয়ঃসন্ধির সময় কৈশোর তারুণ্যের সুখের সৌধ

 

কৈশোর তারুণ্যের সুখের সৌধ | বয়ঃসন্ধির সমস্যা | শিশুর মন ও শিক্ষা

কৈশোর তারুণ্যের সুখের সৌধ :তিনটি বিষয়ের অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে সুখের সৌধটি— স্বীকৃতি পাওয়ায়, স্নেহ- ভালবাসা পাওয়ায় এবং অর্জনের সম্পন্ন প্রাপ্তিতে। অ্যাকসেপ্টেন্স, অ্যাফেকশন এবং অ্যাচিভমেন্ট। এই তিনটি প্রায়ই বিঘ্নিত হয় কৈশোরে। স্বীকৃতি বা মান্যতার ব্যাপারটি নিজের কাছে যেমন সত্য অপরের কাছে, সমাজের কাছে পাওয়াটাও তেমনি সত্য। এই দ্বিপ্রান্তিক স্বীকৃতি বা মান্যতা আবশ্যিক। আমার যা কিছু আছে তাই আমার অনেক— এই উপলব্ধি। সেই থাকাটা অনেক অন্যের সম্পন্নতার তুলনায় কম হতে পারে।

কিন্তু অনিবার্যভাবেই সেই আমার সম্পদ অনেক অন্যের তুলনায় অনেক বেশিওতো বটে। তাহলে? আবার সমাজ-পরিবার-পরিজনও ঠিক তেমনি করে যদি কৈশোরের স্থানাংক মূল্যাংক বিষয়ে সহানুভূতিশীল হয়ে প্রকাশ পায় তাহলে সুখের প্রবেশ পথটি অবারিত হতে পারে। নেতিবাচক মূল্যায়ন, অর্ধপূর্ণ গ্লাসের অর্ধেক পূর্ণ না দেখে অর্ধেক শূন্য বলে দেখা এবং দেখানো অনেক অকারণ ক্ষতির কারণ হতে পারে।

উত্তম-অমিতাভ্ অথবা মাধুরী-শ্রীদেবী। কালিদাসের তন্বী-শ্যামা…. অথবা বঙ্কিমের উন্নত-বক্ষ- আজানুলম্বিত-বাহু…..। কল্পনার ঘুড়ি আর দিবাস্বপ্নের বন্যা কোনোটাই সুখের পাথেয় নয়। যা আছে শীলনে পরিশীলনে তাকেই সম্পন্নতর করে তুললে সেই বা কম কি? সুন্দরের অবস্থানটি কোথায়? দেহে, না মনে? নাকি, অর্জনে-প্রাপ্তিতে?

কৈশোর তারুণ্যের সুখের সৌধ | বয়ঃসন্ধির সমস্যা | শিশুর মন ও শিক্ষা

স্নেহভালবাসা? মন করলেই তো দেওয়া যায় কারণ ওগুলো তো আর বাইরে থেকে সংগৃহীত সামগ্রী নয়, ইচ্ছার সন্তান, সংবেদনশীল মনের অপত্য। সকলেই চায়; শিশুরা- কিশোররা একটু বেশি বেশি করে চায়। আর যদি পায় তাহলে ‘ডোন্ট কেয়ার’ ভাবটা তো দানা বাঁধতে সুযোগই পায় না। মা-বাবার আছে শত শত জ্বালা-যন্ত্রণা-ঝামেলা। আছে। কিন্তু সেই কারণে কৈশোর কেন বঞ্চিত হবে? ধৈর্য, ম্যাডাম ধৈর্য। পূর্বপ্রস্তুতি, মিস্টার, পূর্বপ্রস্তুতি চাই। সন্তানকে মানুষ করতে হবে, মেষ শাবক তো নয়! (মানুষ আমরা নহিত মেষ …. ইত্যাদি)।

অর্জন-প্রাপ্তি? যা ওরা পারে বলে মনে করবেন তা যদি না পারে তাহলে ওরা লজ্জায়, আত্মনির্যাতনে আর অপরাধবোধে আক্রান্ত হবে। সেই অবস্থায় ওদের কাছে, পাশে, বসে সাহায্যের সহানুভূতির হাতটি বাড়িয়ে দিন। দেরি হলে সব নষ্ট হয়ে যাবে। লজ্জার জায়গায় ধৃষ্টতা এসে পড়বে, আত্মনির্যাতন হয়ে যাবে আত্মম্ভরিতা। অপরাধবোধ? কপ্পুর হয়ে যাবে। যা ছিল নম্রনত, অপেক্ষায় একাগ্র, ভবিষ্যমুখী, প্রচেষ্টায় একলব্য (কিন্তু অবস্থার কারণে অর্জনে-প্রাপ্যে পৌঁছোতে পারছিল না) তাই ক্রমশ মা-বাবা-অভিভাবকদের অনবধানে- অক্ষমতায়-অপ্রচেষ্টায় রূপান্তরিত হবে উদ্ধত-উৎকেন্দ্রিক, অনপেক্ষ-বিক্ষিপ্ত, অতীত-মুখী এবং অপ্রচেষ্টায় ছিন্নবিচ্ছিন্ন। সুখ? তখন হয়ে যাবে ‘কোথা পাবো তারে?’ সন্তানের পক্ষে, মা-বাবার জন্যেও। তাই, ‘সময় যখন থাকে, তখন সময় যেন থাকে।’ আমরা যদি উত্তম তাহলে ওরা (আমাদেরই সন্তান) ‘অধম’ হইবে কেন? / অথবা, ওরা যদি ‘অধম’ তাহা হইলে আমারা ‘উত্তম’ না হইব কেন?

 

কৌমারকাল :

প্রাপ্তেতু ষোড়শে বর্ষে…. ষোল বছর বয়সের পুত্রের সঙ্গে মিত্রের মতো আচরণ করা বিধেয়। কন্যাদের কথা সংস্কৃতে বলা নেই; মনোবিজ্ঞানে পরিষ্কার বলা আছে। তবে ষোল নয় ইংরেজিতে টিন-এজ, বাংলায় তরুণ-তরুণী বললে অথবা কুমার-কুমারী বললে কাছাকাছি হয় মনে হয়।

তারুণ্যের সুখের সৌধ ‘মনে হয়’ কেন বলা হল তাই বলি। বাংলায় বালক-বালিকা, কিশোর-কিশোরী, তরুণ- তরুণী এবং যুবক-যুবতী বলে একটা পরিবর্তনশীল বয়স-সময়-মানসিকতা-পূর্ণতা প্রকাশের নামকরণের, চিহ্নিতকরণের ব্যাপার আছে। চলে আসছে। ইংরেজিতে প্রি- এবং পোস্ট- প্রিফিক্স সহযোগে চাইল্ডহুড, অ্যাডোলেসেন্স, অ্যাডাল্টহুড বা ইউথ বলে কাজ চালিয়ে চলেছে। আমরা জীবনের যে কেন্দ্র-প্রসার বলয়ে আমাদের আলোচনা করছি তার কেন্দ্রবিন্দুতে বয়ঃসন্ধি এবং সেই কেন্দ্রের পূর্ব ও পর অগ্রগতিকে সামিল করতে মনস্থ করেছি।

যৌনজীবনারম্ভের পরবর্তী পর্যায়কে ইংরেজিতে অ্যাডোলেসেন্স বলে, আমরা কৌমার কাল বা তারুণ্যের প্রবর্তনা বলবো। প্রি-অ্যাডোলেসেন্স কাল বলে যে সময় চিহ্নিত তা তেরো থেকে ১৬/১৭ পর্যন্ত; পোস্ট-অ্যাডোলেসেন্স কাল ১৭/১৮ অথবা আইনগত ব্যক্তিস্বীকৃতির কাল। যৌবন প্রাপ্তিতে এই প্রবর্তনার সমাপ্তি। আইন ও সমাজের সার্বিক স্বীকৃতিতে। অনুরূপ ভাবে আমরা প্রথম কৌমার ও দ্বিতীয় কৌমার কাল অথবা প্রথম তরুণ দিন, দ্বিতীয় তরুণ দিন বলেও প্রকাশ করতে পারি। ভাষার সাযুজ্য যেমন দাবি করবে।

 

কৌমারকালের বৈশিষ্ট্য কি ?

১. ইংরেজিতে যা টেরি টিনস্ বাংলায় তাকে কল্লোল-কৌমার বা তটস্থ তারুণ্য বলা যায়। সব কালই বিশেষ বিশেষ কাল; কৌমার কাল সবিশেষ – শরীর ও মনের গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনাদির কারণে, তাদের তাৎক্ষণিক ও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবের নিরিখে। মানসিক প্রতিন্যাস-প্রতিযোজনার বীজ উপ্ত হচ্ছে, নতুন নতুন মূল্যবোধ ও আগ্রহের এলাকায় কর্ষণ চলছে, জীবনের বর্ণমালায় প্রাথমিক পাঠ নেওয়া চলছে। এই সবই প্রথম কৌমারকালে ঘটে চলেছে। অসীম এর গুরুত্ব, সীমাহীন এর তাৎপর্য।

২. কৌমার একটি লাফ-তক্তার কাল, অনাগত জীবনে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্যে প্রস্তুতির কাল। ট্রানজিশনাল অবস্থান। পরিবর্তন ও সমৃদ্ধির একটা স্তর পার হয়ে অন্য একটি অধিকতর সমৃদ্ধ স্তরে উন্নীত হবার কাল। অতীতের জীবন ও অভিজ্ঞতারা তাদের পদচিহ্ন-স্মৃতিচিহ্ন রেখে গেছে; আবার ভবিষ্যতের জীবন ও প্রেক্ষিতটি তীব্র ভাবে ডাক দিয়ে যাচ্ছে, নাড়া দিচ্ছে।

একই সঙ্গে কৌমারের আছে কৈশোরের নিরিখ, আর যৌবনের হাতছানি। তরল কৈশোর ব্যবহারে ‘ছেলেমি করোনা’-র নিন্দা; অন্যদিকে গভীর যৌবনের যোগ্য আচরণে ‘পাকামি করোনা’-র খোঁচা! কৌমার তাই অনেকখানিই অনির্দেশ্য, অস্পষ্ট, অচিহ্নিত ব্যবহারের কাল। এপারের বালখিল্য দিন শেষ, ওপারের শক্তমাটির ছোঁয়া এখনো ঠিক ঠিক পেয়ে ওঠেনি— মধ্যিখানে চর; কৌমার এই চরবাসী জীবনের নাম !

৩. কৌমার এক পরিবর্তনের কাল। পঞ্চধারায় এই পরিবর্তন এসে পড়ে :

ক) আবেগীয় আধিক্যের পরিবর্তন। দেহজ-মনজ অবস্থান-পরিবর্তনের অনিবার্য সহগ
হিসেবে এই আবেগের আধিক্য এদের ঘিরে রাখে। খ) অনিশ্চয়তার মার খেয়ে এরা অস্থির। যৌন পরিবর্তনের দ্রুত অবস্থাত্তরের সহগ হয়ে বয়ঃসন্ধির সমস্যা

কী, কেন, কেমন-এর উত্তরহীন প্রশ্নতাড়নায় অস্থির বোধ করে। ক্ষমতা-যোগ্যতা-আগ্রহে প্লাবনের ঢেউ লাগে, অনিশ্চয়তার দোলা লাগে। আর এটা বেড়ে যায় মা-বাবা শিক্ষক- শিক্ষিকা আত্মীয়-স্বজনদের সহানুভূতিহীন প্রতিক্রিয়ায়, মমতাহীন মূল্যায়নে।

গ) নব নব দায়দায়িত্বের বোঝা এবং সেই বোঝা পূরণে দ্বিধা দ্বন্দ্ব । দেহে, মনে, আগ্রহে- সেবায় এবং অংশগ্রহণে সমাজ এদের কাছে যা আশা করে, যে সব দায়দায়িত্ব পালনের দাবি করে সে সব এদের নতুন সমস্যায় ফেলে দেয়। অভিজ্ঞতা নেই বলে ছাড় পায় না। স্বাভাবিক সমাধান খুঁজে না পেয়ে বিব্রত-বিষণ্ণ হয়ে পড়ে। বিপন্নও।

ঘ) আচার-আচরণের, আগ্রহ-মনোযোগের এলাকা যেমন পালটে যায় তেমনি পালটে যায় এদের মূল্যবোধগুলোও। পুতুলের ঘর, খেলার মাঠের হৈচৈ, দলবদ্ধ সঙ্গীসাথী— সব যেন কেমন অন্যরকম হয়ে যায়। বিষয় পাল্টায়, বন্ধুর সংখ্যা কমে যায়, পরিমাণের বদলে গুণমানের প্রতি টান বাড়ে।

কৈশোর তারুণ্যের সুখের সৌধ | বয়ঃসন্ধির সমস্যা | শিশুর মন ও শিক্ষা

ঙ) একটা অবুঝ বিহ্বলতা, দ্বিখণ্ডিত বোধের শিকার হয়। এরা স্বাধীন হতে চায়, দাবি করে, আবার একই সঙ্গে স্বাধীনতার দায়দায়িত্বের কথা ভেবে ভয় পায়। চাই বলে দাবিটা অন্তরের মধ্যে টের পায় অথচ সেই চাওটাকে অনুসরণ করার প্রস্তুতিপর্বটি তখনও পার হওয়া হয়ে ওঠে নি। বিপদ।

এই সময়ের ভাব-ভালবাসার ‘জল’-তরঙ্গ রোধকরা অত্যন্ত কঠিন কাজ। সমস্যাটি অত্যন্ত গভীর এবং ব্যাপক। সন্তানদের পক্ষে, অভিভাবকদের জন্যে এবং সমাজের কারণে। ভোগ এবং ভোগান্তি হয় সকলেরই কিন্তু রক্ত ঝরে সন্তানদের। তারা দীর্ণ হয়ে পড়ে, জীর্ণ হয়। নিদারুণ এক বর্তমানকে বয়ে নিয়ে হাজির হয় যন্ত্রণা কাতর এক ভবিষ্যতের জীবনে।

অসীম এবং অনাস্বাদিতপূর্ব এক জৈব তাড়না-প্রেরণা-ইচ্ছা ভিতর থেকে শক্তির যোগান দিতে থাকে। এই অবস্থার মুখোমুখি হয়ে কেউ ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে গুটিয়ে যায়। স্বাভাবিক নয়। কল্পজগতে তৃপ্তি-শান্তি-পরিপূরণ খুঁজে নেয় কেউ কেউ। স্বাভাবিক, যদি বিকৃত পথ গ্রহণ না করে সুকৃত পথ অনুসরণ করে। যেমন গল্প লেখা, কবিতা সৃষ্টি, অথবা যেকোনো শিল্প- প্রকরণে প্রকাশ খোঁজা। সাবলিমেশন, র‍্যাশনালাইজেশন, রিডাইরেকশন। আর একদল আছে যারা ইচ্ছাগুলোকে স্বাধীন-স্ব-অধীন মনে করে যথেচ্ছ আচরণের পথ খুঁজে নেয়। এরা প্রধানতই আধুনিকতার শিকার হয়ে পড়ে। টিভি, রেডিও, খবরের কাগজ থেকে এরা প্রশ্রয় খোঁজে, দিক নির্দেশ পায়। এরা আধুনিক জীবনের প্রবাহ থেকে ক্ষিরাম্বুমধ্যাৎ মনের বা স্বভাবের হয় না, পোকা মাকড় খুঁটে খুঁটে খেতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। ফ্রিডম এবং লিবার্টিকে এরা লাইসেন্স ভেবে অনুসরণ করে, মাতাল হয়ে ওঠে।

এদের এই মনোভাবের মূলে সেচনটি আসে বা বাতাবরণটি তৈরি হয় তিন ধরনের অভিভাবক মানসিকতার কারণে : অটোক্রেটিক, ডেমোক্রেটিক এবং পারমিসিভ অভিভাবকদের কারণে। (‘শিশুর মন ও শিক্ষা’ গ্রন্থে বিস্তারিত আলোচনা আছে।)। সময় থাকতে তাই অভিভাবকদের যোগ্য ও ‘শিক্ষিত’ হয়ে ওঠাটা অত্যন্ত জরুরি। সমাজ বলতে যা বোঝায় তাও তিনটি প্রধান প্রেক্ষিতের সূচনা করে : কনজারভেটিভ র্যাশানালিস্টিক এবং মডার্নিস্টিক। প্রধানত গ্রাম্যসমাজ, শহরতলির মধ্যবিত্ত সমাজ এবং শহরের উচ্চবিত্ত সমাজ।

প্রত্যেক মা-বাবাকে তাই সচেতন হয়ে নিজ নিজ সামাজিক প্রেক্ষিতের সূচকে পারিবারিক বাতাবরণ তৈরি করে দিতে হয় সন্তানদের বর্তমান চরিত্র ও ভবিষ্যৎ ব্যক্তিত্ব গঠনের উপযোগী করে। বৈপরীত্য-সংঘাত যা কিছু ঘটবে তা সবকেই ধীরতা ও বিশ্লেষণের সাহায্যে, সন্তানদের সামিল করে নিয়েই, সমাধানের পথ খুঁজে নিতে ও দিতে হবে। সব কথার শেষ কথাটি ব্যক্তি মনের আশা আকাঙ্ক্ষার কথা, সন্তানের মনের গভীরে উপ্ত মূল্যবোধ-আদর্শবোধ-ঔচিত্যবোধের কথা। এটা কখনও ভোলা যাবে না। এর জন্যে একটি রোল মডেল চাই। অবশ্যই চাই।

৪. কৌমার এক সমস্যাসঙ্কুল কাল। সব বয়সের বা জীবন পর্বের নিজস্ব সমস্যা আছে কিন্তু কৌমার কালের সমস্যা একটু সবিশেষ। দুটি প্রধান কারণে —
এক, ছোটবেলার সমস্যা মা-বাবাই দেখেন, সমাধান করে দেন। কিন্তু এই সময়ের সমস্যা ভিতর থেকে অংকুরিত বেশি, তারুণ্যের কাছে অ-ভূতপূর্ব, মা-বাবার কাছেও তেমন খোলামেলা নয়। এরা তাই একা পড়ে যায়, অসহায় বোধ করে।
দুই, এরা মনে করে যে এরা স্বাধীন, সক্ষম এবং নিজে নিজেই সব সমস্যার সমাধান করে নেবে, নিতে পারবে।

মা-বাবা বা শিক্ষক শিক্ষিকারা এগিয়ে এলেও এদের আত্মম্ভর মানসিকতায় প্রত্যাখ্যাত হয়ে যান। ….. আবার পথও ছাড়বে না— কী বিপদ! ‘ক্ষমতা আছে রাখিতে ধন, তারই রাজা হওয়া সাজে!’ তা এই সব ক্ষমতাহীন তারুণ্য মনের জেদে সমস্যা সমাধানের ‘রাজা’ সাজতে চায়। বিফলতা তো তাই দেয়াল লিখন হতে বাধ্য। অনেক ট্রাজেডি এই কারণেই ঘটে। যৌন জীবনের অ-আ-ক-খ না জেনেই সব জানতা বনে গেলি মা (অথবা বাপ)! এই অজ্ঞতার গভীরে আত্মম্ভর বিচরণের ঝোঁকটাই বড়ো সমস্যা। জেনে বুঝে নিলে সমস্যা অনেক কমে যায়।

৫. ব্যক্তিত্ব উদ্ঘাটনের সময়। কদিন আগেও যারা দঙ্গল জীবনে অভ্যস্ত ছিল তারা এখন নিজ নিজ স্বতন্ত্র অবস্থান খুঁজে নিতে মনোযোগী হয়ে পড়ে। ইগো-কনসাসনেস্, আত্মসচেতনতা। অনুকরণ যোগ্য ব্যক্তিত্ব; মডেল, রোল মডেল, আইডিয়াল; আগ্রহ- মনোযোগের এলাকা স্বাতন্ত্র্যীকরণ, দ্রব্য-বস্তু-সম্ভারের প্রতি আকর্ষণ, স্ট্যাটাস সিম্বল’ বা সামাজিক অবস্থানের মাত্রা ও মার্গ নিশ্চয় করা— এই সবের মাধ্যমে এরা স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব প্রকাশ করতে চায়। নিজেদের মনের মধ্যে নিজের ভবিষ্যতের একটা চেহারা ক্রমশ সত্য করে তুলতে চায়।

এই বিষয়টির গুরুত্ব অপরিসীম। রোল-মডেল গঠন, অনুসরণ এবং অনুকরণ। বিচার বিবেচনার স্থান কম থাকে, আবেগ অনুভবের চাপ বেশি থাকে। যে ব্যক্তিকে এরা রোল মডেল বলে ধরে নেয় তাঁর মন-মানসিকতা, অবজেকটিভ কনডিশনস্, জীবন দর্শন, চিন্তা-

কৈশোর তারুণ্যের সুখের সৌধ | বয়ঃসন্ধির সমস্যা | শিশুর মন ও শিক্ষা

ভাবনা-লক্ষ্য-আদর্শ ইত্যাদি বিষয়ে কিছুই প্রায় জানা থাকে না। কয়েকটি প্রকাশিত গুণ- বৈশিষ্ট্যের প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে পড়ে। অনেক কৈশোর-তারুণ্য ভবিষ্যৎ জীবনে এই কারণেই অনেক দুর্ভোগের শিকার হয়। সেই কারণেই মা-বাবার দায় অনেক বেশি। সন্তানকে যথাযথ পথনির্দেশের। ব্যক্তিকেন্দ্রিক রোল মডেল প্রাথমিক পর্যায়ে অনিবার্য-স্বাভাবিক। পরে সন্তানকে বিমূর্ত গুণ-মূল্য-আদর্শ কেন্দ্রিক লক্ষ্য নির্ধারণ করে নিতে সাহায্য করা দরকার। কংক্রিট থেকে অ্যাবস্ট্রাকট। ভবিষ্যৎ পীড়নের হাত থেকে বাঁচার সেটাই পথ, হতাশার যন্ত্রণা থেকে মুক্তির, প্রতারিত-বোধ থেকে উত্তরণের।

কারণ সেই রোল-মডেলের বাস্তব জীবনের কোনো অধঃপতন, কোনো আদর্শচ্যুতি, কোনো নীচতা-দীনতা-হীনতা এই অনুসারী তরুণ মনকে ছিন্ন ভিন্ন করে দিতে পারে। নৈর্ব্যক্তিক রোল-মডেলের বেলায় তেমন সম্ভাবনা থাকে না, কারণ তা নিজের কল্প-মনের আপন শিল্প সৃষ্টি।

‘ভাষা ও ছন্দ’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ (র. র. ৩/৯১৪) বাল্মীকি মনের যে অবস্থা- বর্ণনা করেছেন সেই অবস্থার অনেকটাই ‘তরুণ গরুড়সম’ এক মহৎ ক্ষুধার আবেশে কৈশোর মনকেও পীড়ন করে। ‘বেদনায় অন্তর করিয়া বিদারিত’ এই সব তরুণদের মনেও জন্ম নেয় এক ‘পরিপূর্ণ বাণীর সংগীত’। তারে লয়ে ভাবে এরা ‘কী করিবে’ ‘কি তার উদ্দেশ’। এদের প্রশ্ন প্রায় একই :

কহ মোরে কার নাম অমর বীণার ছন্দে বাজে। কহ মোরে বীর্য কার ক্ষমারে করে না অতিক্রম কাহার চরিত্র ঘেরি সুকঠিন ধর্মের নিয়ম ধরেছে সুন্দর কান্তি মাণিক্যের অঙ্গদের মতো, মহৈশ্বর্যে আছে নম্র, মহাদৈন্যে কে হয়নি নত, সম্পদে কে থাকে ভয়ে, বিপদে কে একান্ত নিৰ্ভীক, কে পেয়েছে সব চেয়ে, কে দিয়েছে তাহার অধিক, কে লয়েছে নিজ শিরে রাজভালে মুকুটের সম সবিনয়ে সগৌরবে ধরামাঝে দুঃখ মহত্তম অদর্শকে গুণের সমাহারে কল্পবদ্ধ করে নিলে পতনের ভয় থাকে না ।

৬. কৌমার এক ভয়াবহ কাল, সন্ত্রাসের সময়। অনেকের মতে এই সময়টি ঢিলাঢালা, অবিন্যস্ত, ধ্বংসকারী, অসামাজিক, সন্দেহজনক ইত্যাদি। এই ধরনের একপেশে ধারণার হেতু খুবই সহজবোধ্য। এক, কৌমার-তারুণ্য পরিবর্তনশীল বর্তমানকে নিয়ে, অজানা সব বিস্ময় নিয়ে ব্যতিব্যস্ত, অন্তর্বীক্ষণে একা-একা, এবং বিব্রত। সেই অবস্থায়, দুই, মা-বাবা শিক্ষক শিক্ষিকাদের সহানুভূতিহীন প্রতিক্রিয়া, যোগাযোগের সেতুহীন অবস্থান। এই উভয় অবস্থার ফল হিসেবে এমতো মূল্যায়ন। অকারণ খিটিমিটি, অবুঝ বৈপরীত্য-বিরোধিতা, ছিলা-টান্-

টান অভিমান এবং সুতরাং অনুযোগ-অভিযোগ-ফরিয়াদ। কে দায়ী? কে দেবে উত্তর? বাস্তবতাবোধহীনতার অবস্থান। জীবনকে এরা রঙিন দেখতে ভালবাসে। রঙিন চশমার প্রভাবে রমণীয় দেখে। ভিতরের নবোম্মেষ ফল্গুপ্রবাহের প্রভাবে আর দেহের রমণীয় বরণীয় পরিবর্তনে এরা মনে করে জীবন কাব্যময়। নিজেদের এবং অপরকেও আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে দেখে। আশা-আকাঙ্ক্ষা, বাসনা-কামনা সবই আকাশের নীলে আর বাতাসের পালকে মাখিয়ে দেখতে থাকে। ছন্দময় ভাবালুতায়। আর যখন স্বপ্নভঙ্গ হয় তখন মরমে আহত বোধ করে, বাস্তবের আঘাতে জর্জরিত হয়।  ওরা যদি প্রথম থেকেই যুক্তির যাথার্থ্যে, বিশ্লেষণে-বিচারে, প্রত্যক্ষের নিরিখে জীবনকে দেখার দৃষ্টিটা পায় তাহলে বাস্তব অতটা অবাস্তব হয়ে ভবিষ্যৎ আঘাতের কারণ হয়ে ওঠে না। এটা করা অভিভাবকের কাজ। অনুসরণ করা ওদের দায়।

৮. তারুণ্য এক পূর্ণতার সোপান। কচিকাচা কৌমার ক্রমশ ডাঁটো হয়ে উঠে আইনানুগ- সামাজিক ব্যক্তিজীবনে, যৌবনে, পৌঁছোয়। এই অনাগতের অনুভবে এদের সাজগোজ পাল্টে যায়, ধরনধারণ গভীর গম্ভীর হয়ে ওঠে, চলনে-বলনে অনাগতের শংখধ্বনিটি আর তেমন লুকোনো থাকে না। যে কোনো উৎসব অনুষ্ঠানের দিনে চোখ কান সজাগ রাখলে তারুণ্যের এই যৌবন চেতনা ধরা পড়তে বাধ্য।

এ পর্যন্ত আলোচনায় কয়েকটা বিষয় পরিষ্কার : এক, কৈশোর-কৌমার বিষয়ে শারীরিক, মানসিক এবং যৌন পরিবর্তনাদির কার্যকারণ বিষয়ে ওদের, সন্তানদের, অনেক জানার থাকে, জানানোর থাকে। প্রস্তুত করার প্রয়োজনও আছে। দুই, মা-বাবা-অভিভাবকরা এই কেন্দ্র-বৃত্ত- বলয় ব্যাপী যৌন বিষয়ের আলোচনা করতে অস্বস্তি বোধ করেন। তিন, অনেকের জানাগুলোও তেমন সম্পূর্ণ নয়। চার, মা-বাবা ও সন্তানদের মধ্যে কাঙ্ক্ষিত রকমের মানসিক সেতুবন্ধন থাকে না। ফলে দুপক্ষই দুর্ভোগের শিকার হয়ে পড়ে। সন্তানদের বেলায় ওদের বর্তমান ছিন্নভিন্ন হয়ে ভবিষ্যতের পথও কণ্টকাকীর্ণ হয়ে পড়ে। দায় তাই মা-বাবার-অভিভাবকদেরই বেশি। রবীন্দ্রনাথের সাহায্য নেওয়া যাক খোকার মনের ঠিক মাঝখানটিতে

আমি যদি পারি বাসা নিতে –
তবে আমি একবার
জগতের পানে তার
চেয়ে দেখি বসি সে নিভৃতে।
(খোকার রাজ্য। শিশু। র. র. ২/১৫)

শুধু খোকার নয়, কৌমার-তারুণ্যের মনের মাঝখানটিতে মা-বাবারা একটু স্থান করে নিয়ে ওদের চোখেই ওদের জগৎ ও সমস্যাগুলো দেখে বুঝে নিতে পারেন।

আরও দেখুন:

Leave a Comment