শিশুর ধারণাগঠন ও বোধশক্তি

ধারণাগঠন ও বোধশক্তি – বিষয় নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি “শিশুর মন ও শিক্ষা” সিরিজের অংশ। শিশুর মন ও শিক্ষা , আমরা প্রতিযোজনের কথা দিয়ে ‘বুদ্ধি’র কথা শুরু করেছি। এবারে প্রথম বাল্যের শিশুরা কেমন বোধ বা ধারণা গড়ে তোলে তা একটু দেখা যাক। একে অবধারণ বা understanding বলা চলে। এই সব ধারণার সবগুলি সকলের মনে একইভাবে একই সময়ে তৈরি হয় না। আসে না।

শিশুর ধারণাগঠন ও বোধশক্তি

তবুও এই ভিন্ন ভিন্ন অবস্থানের মধ্যেও কয়েকটি ধারণাকে আলাদা করে বলা যায়—
১. জীবন, জীবন্ত, প্রাণবন্ত : ধারণা বা category-টি তৈরি হয়েছে। প্রাণবান – মানুষ, কুকুর-বিড়াল ইত্যাদিতে প্রয়োগ করবে। আবার পুতুল খড়-পোরা বাছুরেও প্রয়োগ করবে। আকাশের মেঘে মহিষ বা হাতি দেখতে পাবে।

২. মৃত্যু, মরণ, প্রাণহীনতা : অভাবকে মনে করবে। ছিল কিন্তু এখন নেই—এই অবস্থার একটা ধারণা। প্রকৃত ধারণা গড়ে ওঠে নি।

৩. শারীরিক কাজকর্ম, ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া : স্বচ্ছ ধারণা নয়। আবছা-অস্পষ্ট। অনেক অস্পষ্ট ধারণা তো দ্বিতীয় বাল্যে পৌঁছতে পরিষ্কার হবে না। মাঝামাঝি গেলে বইপত্র পড়ে ছবিটবি দেখে এবং শুনে টুনে ক্রমশ পরিষ্কার হবে।

৪. স্থান, দূরত্ব, উঁচু-নিচু অবস্থান : ডান দিক বাঁ দিক, উপর-নিচে, কাছে দূরে ইত্যাদি ধারণা গড়ে ওঠে। যদিও দূরত্ব অত্যন্ত বেশি হলে ধারণায় ধরতে পারবে না।

৫. ওজন, ভার, হালকা-ভারি : ক্রমশ পরিষ্কার হয় ধারণাগুলো। প্রথম প্রথম আকৃতি বা চেহারা দেখে ওজন বুঝতে চায়। অভিজ্ঞতা ধীরে ধীরে বোঝায়

৬. সংখ্যা ঃ সামান্য কয়েকটি সংখ্যা বোঝে—একটা দুটো তিনটে। তারপরেম্ন 8 ৫ করে অনেক দিনে শেখে। ধীরে ধীরে।

৭. সময় : ঘণ্টা মিনিট প্রথম দিকে মাথায় ঢোকে না। স্থায়িত্ব বা duration ও না । মাপতে পারে না সময়, কাজ দিয়েও না, ঘড়ি দিয়েও না। ৪–৫ বছরের শিশুরা বার জানে, পরে মাস জানে। ঋতু ও বছর জেনে যায় ।

৮. স্বজ্ঞান, আত্মজ্ঞান : নাম বছর তিনের শিশু ছেলে-মেয়ে বোঝে, নিজেকে শরীর দিয়ে চেনে, অঙ্গপ্রত্যঙ্গের নাম জানে।

৯. সামাজিক ধারণা : প্রথম বাল্য শেষ হবার আগেই কে ভাল কে মন্দ ইত্যাদি গুণ ও বর্ণনা বুঝে যায়, চিনে যায়।

১০. সৌন্দর্য্যবোধ, সুন্দরের ধারণা গড়ে ওঠে। ১১. মজা-কৌতুক : টের পায়। প্রকাশ করতে পারে।

১২. Sex-role : ছেলেরা বছর পাঁচেকের হলেই বুঝে যায়। মেয়েদের বেলায় বুঝতে একটু দেরি হয়। এর কারণ সমাজে ছেলেদের কাজকর্ম ইত্যাদি বেশ পরিষ্কার বোঝানো হয়—ছোটবেলা থেকেই। সদর্থক বা ইতিবাচক করে। মেয়েদের বেলায় নেতিবাচক থাকে।

বুদ্ধি : Intelligence.

অনেকে বলেন কোনো কিছু শেখার জন্যে যে ক্ষমতা কাজ করে তাই বুদ্ধি। অনেকে বলেন নতুন অবস্থায় মানিয়ে চলার ক্ষমতা বা পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে চলার ক্ষমতাই বুদ্ধি। অনেকে বলেন বুদ্ধিমাপার প্রশ্ন-পরীক্ষায় যে ক্ষমতা বা যোগ্যতা ধরা পড়ে তাই বুদ্ধি। ক্ষমতা না বলে যোগ্যতা দক্ষতা কুশলতা নৈপুণ্যও বলা চলে। কেউ কেউ তাই বুদ্ধিকে ক্রিয়াশীল বলে সংজ্ঞার্থ দিয়েছেন—বোধকে কাজে লাগালেই বুদ্ধি— Intelligence is intellect put to use. অনেকে বলেছেন প্রদত্ত থেকে অপ্রদত্তে সম্পর্ক নিকষিত করাই বুদ্ধি। অথবা, এক বা একাধিক প্রদত্ত বস্তু বিষয় বা সম্পর্ক দেখে অন্য কোনো বস্তু বা সম্পর্কের ক্ষেত্রে সেই দেখা সম্পর্ককে প্রয়োগ করার কুশলতাই বুদ্ধি। বেশ জটিল করেই বলা গেল! অংকের বেলায়, জ্যামিতির প্রতিপাদ্যে সবই তেমন সরল নয়। অথবা এখন যতো IQ test হয় বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষায়।

বিলাশী বুদ্ধিশুশি

পরিশীলিত শিক্ষাই বুদ্ধি। আজন্ম গুণ নয়, learned skill, skill to learn. এখানেই লেখাপড়ার কথা এসে পড়ে। গাড়ি ঘোড়া চড়ার জন্যে নয় নৈপুণ্য-কুশলতা-যোগ্যতা বাড়ানোর জন্যে। [হাতে কলমে কাজ করেও বাড়ানো যায়, শেখা যায়। সেটা প্রধানত যান্ত্রিক নৈপুণ্য; বুদ্ধির নৈপুণ্যের ভিত্তি reasoning বা যুক্তি ক্রিয়ার প্রয়োগ কুশলতা। সেখানে লেখা পড়া বলা এবং লেখাপড়া—একাধারে একাকার।]

সকলেরই প্রায় জানা যে Alfred Binet বুদ্ধি পরিমাপের ক্ষেত্রে স্মরণীয় নাম। বুদ্ধির আংকিক অবস্থান, বুদ্ধাংক নির্ণয় বিষয়ে একটি সূত্র তৈরি করেন। শিশুর প্রকৃত বয়স এবং মানসিক বয়স বলে দুরকমের বয়সের কথা বলেন। Chronological Age (CA) হলো জন্ম তারিখ থেকে পঞ্জিকা মতে যে বয়স তাই। আর প্রত্যেক মানসিক বয়সের জন্যে এক গুচ্ছ প্রশ্ন তিনি তৈরি করেন।

নির্ধারিত বয়সের জন্যে ধার্য প্রশ্নের শতকরা ভাগ উত্তর দিতে পারলে ছাত্রের মানসিক বয়স পাওয়া যাবে। CA ৮ বছর কিন্তু উত্তর দিতে পারলো ১০ বছরের প্রশ্নগুচ্ছের। তাহলে সেই বালকের MA (men tal age) MA = ১০ বছর। কিন্তু যদি উত্তর দিতে পারলো ৬ বছরের প্রশ্নগুচ্ছের তাহলে = ৬ বছর। এই তথ্য হাতে পেলে ছাত্রের বুদ্ধাংক স্থির করা গেল : (MA + CA) × 100, তাহলে কাল্পনিক প্রথম ক্ষেত্রে IQ = (10 = 8) x 100 = 125. দ্বিতীয় ক্ষেত্রে IQ = (6 + 8) × 100 = 75. এবারে 100 সংখ্যাকে গড় সাধারণ ধরে ছাত্রের বুদ্ধির মান পাওয়া গেল।

বুদ্ধাংকের ধারণা ও প্রয়োগ সেই ১৯০৫ থেকে অনেক অনেক পরিবর্তন, পরিবর্ধন, পরিমার্জন পার হয়ে এসেছে। শব্দ ও ভাষা নির্ভর বুদ্ধি পরিমাপের জায়গায় অনেক অন্যতর পরীক্ষা ব্যবস্থা যোগ হয়েছে—কাজের কুশলতা পরীক্ষা, ছবির ব্যাখ্যায় সম্পর্ক ও কল্পনা ক্ষমতা পরীক্ষা, স্মরণ ক্ষমতা পরীক্ষা, উপাদান সংযোজন করে বস্তু নিয়ে তৈরি করার কুশলতা, পাজল সমাধান যোগ্যতা।

Army Alpha, Army Beta Test ইত্যাদি। আবার বুদ্ধির বিভিন্ন উপাদান নিশ্চয় করে factor analysis ব্যবস্থায় আছে ভাষা দক্ষতা (V = verbal) সংখ্যা (N = Number), স্থান বিষয়ক (S Space), শব্দ নৈপুণ্য = (W = Word fluency), স্মৃতি (M = memory) এবং যুক্তিপ্রয়োগ কুশলতা (R Reasoning). = বুদ্ধির এই উপাদানগত বিশ্লেষণে Spearman-এর মতবাদ গুরুত্বপূর্ণ।

তিনি বলেন মানসিক যোগ্যতা (অনেকটা পিরামিডের মতো) শীর্ষ-ভূমি বিন্যাসে বিন্যস্ত : সাধারণ-G = (General factor/ability). এই G দুটি ভাগে (group factor) বিভক্ত : ভাষাগত এবং শিক্ষাগত যোগ্যতা (V: ed = Verbal and educational abilities) এবং অন্যটা বাস্তব বা ক্রিয়াশীল যোগ্যতা (Practical or performance abilities). এই দুইটি বেশি বুদ্ধি শি যেখানে .৫৭ দেখায়, ৬ যতো বেশি কোরিলেশন ৬ মাস পরে সেখানেই .৪২ দেখিয়েছে। । সময়ের ফারাক কিন্তু শিশুরা বড়ো হলে ব্যাপারটা এমন নি ততো কম। বি থাকে না।

অর্থাৎ ৫-৬ বছরের পরে ক্রমশ বেশি সামঞ্জস্য ধরা পড়ে। তিনি ৫. বয়স যতো বাড়ে IQ Score ততো বাড়ে। তবে এই বাড়াটা তুলনামূলকভাবে কম কম হয়। মা বাবার এবং পরিবেশের প্রভাব বেশ জোরালো IQ বাড়াতে। জোরালো হয়ে দেখা দেয় এই জীবন সন্ধির পরে ছেলেদের IQ 2 মেয়েদের তুলনায় একটু বেশি বাড়ে। এই সময়ে উভয় ক্ষেত্রেই বাড়াটা প্রধানত বিমূর্ত যুক্তি প্রয়োগের ক্ষেত্রে এবং শব্দ সম্ভারের এলাকায় ঘটে, যান্ত্রিক মুখস্ত/স্মৃতি বা বাস্তব বোধের এলাকায় কম বাড়ে।

পিতামাতার প্রভাব ও অভিজ্ঞতার উপাদান বৌদ্ধিক উন্নতির সহায়ক। সংস্কৃতির স্বীকৃত বাতাবরণে শিশু যতো বেশি রকমের বৌদ্ধিক কাজে নিজেকে করবে ততোই ভাল। বুদ্ধিকে বিবিধ আচরণের সামগ্রিক প্রতিফলন বলে বলা হয়েছে।

বুদ্ধির উপাদানের কথা বলতে গিয়ে J. P. Guilford একটি ছকের কথা বলেছেন : Theoretical Structure of Intellect (S.I) model.

মানসিক (ability) যোগ্যতার তিনটি মাত্রা :

(১) আধেয় Contents 8 রকম. Figural, Symbolic, Semantic, Behavioral

(২) সক্রিয় দিক Operations ৫ রকম, Evaluation, Convergent Produc tion, Divergent Production, Memory, Cogniton.

(৩) উৎপাদন Products ৬ রকম, Units, Classes, Relations, System, Transformations, Implications.

অতএব সব মিলে ৪ × ৫ × ৬ = ১২০ রকমের মানসিক যোগ্যতা বা ability ‘আছে। এর মধ্যে ৬০ টির মতো নিশ্চয় করা গেছে। একটি ত্রিমাত্রা ঘনক এঁকে নিলে এই অবস্থানটি পরিষ্কার বোঝা যাবে।
অত্যন্ত জটিল। উল্লেখ করেই থামা গেল। ব্যাখ্যায় আরও জটিলতা বাড়বে। একটা সরল বিষয় মনে রাখা দরকার। ছেলেমেয়েদের বিদ্যালয়ের প্রগতি পত্রে, Progress. Report-এ যে অর্জন দেখানো থাকে তা কিন্তু টায় টায় ওদের বুদ্ধির পরিমাপ প্রকাশ করে না। ওদের ভাষা ও শব্দ সম্ভারের প্রকৃতির সঙ্গে অনেকটাই মেলে।

পর্যন্তই দেখা যাবে। বিদ্যালয়ে দেওয়া সাহিত্যের নম্বরের সঙ্গে কম, বিজ্ঞানের নম্বরের সঙ্গে বেশি মিলবে। কারণ শিক্ষক শিক্ষিকাদের বিষয়ীগততা নম্বরকে প্রভাবিত করে। দ্বিতীয়, সাহিত্যের উত্তরে মূল্যায়নে Subjectivity বেশি, বিজ্ঞানের উত্তর মূল্যায়নে বিষয়গততা বেশি থাকে Subjectivity কম থাকে। এবং আগে দেখেছি প্রথম বাল্যের প্রথম দিকের সঙ্গে পরের দিকের তেমন মিল থাকে না। বেড়ে যায় বুদ্ধি এবং বুদ্ধির প্রকাশ। তাই তাড়না না করে শিশুদের সঙ্গে করে এগিয়ে দিলে ভবিষ্যতে আলোর দেখা মিলতে পারে।