শিশুর ধারণা গঠন : শিশুর বোধ শক্তি

শিশুর বুদ্ধিবৃত্তিক ও নৈতিক বিকাশ শুরু হয় জন্মের পর থেকেই। শিশুরা জন্ম নেয় একটি সম্ভাবনাময় মনে নিয়ে, যা ধীরে ধীরে গঠিত হয় চারপাশের পরিবেশ, পরিবার, শিক্ষা ও সামাজিক মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে। শিশু মনস্তত্ত্ববিদরা যেমন Jean Piaget, Lev Vygotsky, এবং Erik Erikson দেখিয়েছেন—শিশুদের চিন্তা, বোধ ও নৈতিকতা সময়ের সাথে সাথে নির্দিষ্ট স্তরভিত্তিক পদ্ধতিতে গড়ে ওঠে। এই প্রক্রিয়াটিই মূলত শিশুর ধারণা গঠন এবং বোধশক্তির বিকাশ।

নৈতিক বোধের বিকাশ: Piaget-এর ধাপসমূহ

Piaget শিশুদের নৈতিক চিন্তাভাবনাকে দুটি প্রধান স্তরে ভাগ করেছেন:

১. বহির্নির্ভর নৈতিকতা (Heteronomous Morality)

– বয়স: আনুমানিক ৪–৭ বছর
– শিশু বাইরের কর্তৃত্ব (পিতা-মাতা, শিক্ষক, নিয়ম, শাস্তি) অনুযায়ী সঠিক ও ভুল নির্ধারণ করে।
– কাজের ফলাফলের উপর গুরুত্ব দেয়, উদ্দেশ্যের উপর নয়।

২. অন্তর্নির্ভর নৈতিকতা (Autonomous Morality)

– বয়স: আনুমানিক ৮ বছর থেকে শুরু
– শিশু নিজস্ব যুক্তি, উদ্দেশ্য ও পারিপার্শ্বিক বিবেচনায় সঠিক ও ভুলের মূল্যায়ন করে।
– শাস্তির চেয়ে দায়িত্ব, নীতি, এবং সহানুভূতিকে গুরুত্ব দেয়।

প্রশ্নভিত্তিক বিশ্লেষণ: ধাপে ধাপে পার্থক্য

১. প্রথম বাল্যে কাজের ফল (যেমন: ভেঙে ফেলা) অনুযায়ী বিচার হয়। দ্বিতীয় বাল্যে অভিপ্রায় (ইচ্ছা করে নাকি ভুলবশত?) বিবেচনায় আসে।

২. প্রথম বাল্যে শিশু চিন্তা করে, কাজ হয় “ভুল” নয়তো “সঠিক”। দ্বিতীয় বাল্যে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিচারে শেখে (প্রেক্ষিত নির্ভর চিন্তাভাবনা)।

৩. প্রথম বাল্যে ধারণা—”যা শাস্তি আনে, তা খারাপ”। দ্বিতীয় বাল্যে—”যা ক্ষতি করে বা নীতিবিরুদ্ধ, তা খারাপ”।

৪. প্রথম বাল্যে শাস্তিকেই ন্যায়বিচার ভাবা হয়। দ্বিতীয় বাল্যে ন্যায্য শাস্তি ও ক্ষমা উভয়ের মূল্য বোঝে।

৫. দুর্যোগ-দুর্ভাগ্যকে প্রথম বাল্যে ঈশ্বর/ভাগ্যনির্ধারিত শাস্তি বলে মনে হয়। দ্বিতীয় বাল্যে বাস্তব কারণ অনুসন্ধানে আগ্রহ জন্মায়।

শিশুর ধারণা গঠনের প্রাথমিক স্তর

এই ধাপে শিশুরা বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে কীভাবে চিন্তা করে, সেটি নিচের প্রশ্নগুলোর আলোকে বিশ্লেষণ করা হলো:

১. জীবন, প্রাণবন্ততা ও কল্পনা:

শিশুরা জীবনের ধারণা তৈরি করতে শেখে। তারা মানুষ, পশুপাখি, এমনকি পুতুল, ছায়া বা মেঘেও প্রাণ কল্পনা করে। এই অবস্থাকে Animism বলে—যেখানে অজীব জিনিসেও তারা প্রাণ রয়েছে ভাবতে পারে।

২. মৃত্যু ও অনুপস্থিতি:

“ছিল কিন্তু নেই”—এই বোধ শিশুর মধ্যে গড়ে ওঠে ধীরে ধীরে। শিশুরা প্রথমে মৃত্যুকে ঘুমের মতো ভাবতে পারে। প্রকৃত মৃত্যুর ধারণা গড়ে ওঠে সাধারণত ৭–১০ বছর বয়সে।

৩. শারীরিক কার্যকলাপ ও কারণ–প্রতিক্রিয়া:

এই বয়সে শিশুরা বুঝতে শেখে তাদের কাজের একটি ফল আছে, কিন্তু কারণ–প্রতিক্রিয়ার সম্পর্ক (যেমন: ঠান্ডা লাগলে সর্দি হয়) স্পষ্ট নয়। বই-পড়া, গল্প শোনা, পর্যবেক্ষণ, এবং প্রশ্ন করা তাদের এই ধারণা পরিষ্কার করতে সাহায্য করে।

৪. স্থান ও সময়ের বোধ:

প্রথম বাল্যে (৩–৬ বছর) শিশুরা ‘গতকাল’, ‘আগামীকাল’ ইত্যাদি সময়কে নির্দিষ্টভাবে বুঝতে পারে না। দ্বিতীয় বাল্যে তারা ধীরে ধীরে সময়ের ধারাবাহিকতা বোঝে।

৫. আত্মপরিচয় ও অন্যের দৃষ্টিভঙ্গি:

Piaget-এর মতে, প্রাথমিক বয়সে শিশুরা egocentric অর্থাৎ তারা অন্যদের দৃষ্টিভঙ্গি বুঝতে পারে না। ধীরে ধীরে তারা বুঝতে শেখে যে, অন্যের মতামত তার নিজের মতো নয়।

‍ অন্য মনোবিজ্ঞানীদের দৃষ্টিভঙ্গি (সংক্ষিপ্ত)

Lev Vygotsky

– শিশু শেখে সামাজিক পরিবেশ ও ভাষার মাধ্যমে।
– তাঁর “Zone of Proximal Development” ধারণা বলে, শিশু একা যা পারে না, অন্যের সহায়তায় তা পারে।
– তিনি “সহযোগী শেখা”-কে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন।

Erik Erikson

– শিশুর মানসিক বিকাশ আটটি ধাপে বিভক্ত।
– প্রথম দুটি ধাপ:

• Trust vs. Mistrust (০–১ বছর): শিশুর আত্মবিশ্বাস গড়ে উঠে।
• Autonomy vs. Shame (১–৩ বছর): স্বাধীনতা ও আত্মপরিচয়ের বোধ গড়ে ওঠে।

শিশুর চিন্তা, বোধ ও নৈতিকতা গঠন এক জটিল অথচ সুন্দর প্রক্রিয়া। একে বাহ্যিক নির্দেশনা থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে অভ্যন্তরীণ যুক্তি ও মূল্যবোধের দিকে অগ্রসর হতে হয়। এই বিকাশে পরিবার, শিক্ষক, সমাজ এবং গণমাধ্যমের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

আমাদের উচিত শিশুদের প্রশ্ন করতে উৎসাহিত করা, শাস্তির পরিবর্তে বোঝানোর পথ বেছে নেওয়া এবং তাদের চিন্তার স্বাধীনতাকে সম্মান জানানো। তাহলেই তারা একদিন পরিণত, যুক্তিবাদী ও নৈতিকতাসম্পন্ন মানুষ হয়ে উঠতে পারবে।