কৈশোরের কিশলয় পর্ণে পরিণত হয় | বয়ঃসন্ধির সমস্যা | শিশুর মন ও শিক্ষা

কৈশোরের কিশলয় পর্ণে পরিণত হয় , এই পরিণতির প্রক্রিয়া, এই পর্ণত্ব প্রাপ্তির যাবতীয় অন্তর্লীন পদ্ধতি প্রকরণ ওদের যেমন জানা দরকার অভিভাবকদেরও তেমনি চেনা প্রয়োজন। একই সত্য এবং তথ্য ছোট- বড় উভয় পক্ষ যখন মোটামুটি একই রকম করে জানে-বোঝে তখন অভিযোগ অনুযোগ ফরিয়াদের এলাকা সঙ্কুচিত হতে বাধ্য, বিপদের সম্ভাবনা তিরোহিত হতে সুযোগ পায় আর সব থেকে বড় কথা একে অপরকে বুঝে নিতে পারে অত্যন্ত সহজে, স্বাভাবিক পথেই। “তুই বুঝিস না’ অথবা ‘বড় হলে বুঝবি’-র অন্ধকার অজ্ঞতার মোড়কে ওদের ‘অবুঝ’ না রেখে `সত্য ও তথ্যের সূঝবুঝের আলোকে নিয়ে এলে ক্ষতি কি? উপরন্তু, ওরা মোটেই অ-বুঝ নয়; অনালোকিত উৎস থেকে ওরা বুঝে নেয় অনেক অনেক।

কৈশোরের কিশলয় পর্ণে পরিণত হয় | বয়ঃসন্ধির সমস্যা | শিশুর মন ও শিক্ষা

সেই সবের বেশিটাই মিথ্যা-বিকৃত- বুঝ হতে পারে। তখন ? তখন তো মা-বাবার কথাকেই ওরা ‘অবুঝের’ কথা বলে মনে করে বসতে পারে, অভিভাবকদের অন্ধ-গোঁড়ামি বলে মৃদু হাসতে পারে, অথবা অন্য অনেক কিছুই মনে করে নিজেদের এবং মা-বাবার বিপদ বাড়িয়ে তুলতে পারে।

People Children 542 1 কৈশোরের কিশলয় পর্ণে পরিণত হয় | বয়ঃসন্ধির সমস্যা | শিশুর মন ও শিক্ষা

 

তাছাড়া এই সময়টাতে সন্তানরা স্কুলের যে শ্রেণীগুলো পার হচ্ছে তার দায়দায়িত্ব ক্রমশই বেশি বেশি এবং ভারি ভারি হয়ে উঠছে। এবং সঙ্গে সঙ্গে একের পর এক জীবনের স্তর পার হয়ে হয়ে পরিপূর্ণ জীবনের মালিক হতে চলেছে। এই পথপরিক্রমায় ওদের হাতে সত্য ও তথ্যের আলোকবর্তিকাটি তুলে দিন যাতে নিজেরাই অনেকটা পথ নিজে নিজেই চিনে নিতে পারে। তার সঙ্গে সঙ্গে, এবং পাশে পাশেই নিজেরা থাকুন, সেই পথ চেনাটাকে সহজ করে দিন।

এই বয়ঃসন্ধির কাল বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ ‘ছাত্রশাসনতন্ত্র’ প্রবন্ধে [‘শিক্ষা’, পৃ. ২০৯-১০] বলছেন, “তখন শাসনের সীমানা হইতে স্বাধীনতার এলাকায় সে প্রথম পা বাড়াইয়াছে। এই স্বাধীনতা কেবল বাহিরের ব্যবহারগত নহে; মনোরাজ্যেও সে ভাষার খাঁচা ছাড়িয়ে ভাবের আকাশে ডানা মেলিতে শুরু করিয়াছে। তার মন প্রশ্ন করিবার, তর্ক করিবার, বিচার করিবার অধিকার প্রথম লাভ করিয়াছে। শরীর মনের এই বয়ঃসন্ধিকালটিই বেদনা-কাতরতায় ভরা।

এই সময়েই অল্পমাত্র অপমান মর্মে গিয়া বিঁধিয়া থাকে এবং আভাসমাত্র প্রীতি জীবনকে সুধাময় করিয়া তোলে।…. চিবাইয়া খাইবার বয়স আসিলে বেশ একটু জানান দিয়া দাঁত ওঠে, তেমনি মনুষ্যত্বলাভের যখন বয়স আসে তখন আত্মসন্মানবোধটা একটু ঘটা করিয়াই দেখা দেয়”।

কৈশোরের কিশলয় পর্ণে পরিণত হয় | বয়ঃসন্ধির সমস্যা | শিশুর মন ও শিক্ষা

“বিধাতার নিয়ম অনুসারে বাঙ্গালি ছাত্রদেরও এই বয়ঃসন্ধির কাল আসে, তখন তাহাদের মনোবৃত্তি যেমন এক দিকে আত্মশক্তির অভিমুখে মাটি ফুঁড়িয়া উঠতে চায় তেমি আর-এক দিকে যেখানে তারা কোনো মহত্ত্ব দেখে, যেখান হইতে তারা শ্রদ্ধা পায়, জ্ঞান পায়, দরদ পায়, প্রাণের প্রেরণা পায়, সেখানে নিজেকে উৎসর্গ করিবার জন্য ব্যগ্র হইয়া উঠে।

“ছোটদের বড় দোষ— বড়দের কথা শোনে না যে! বড়দের বড় দোষ— ছোটদের কথা শোনে না সে! ছোটবড়র এই দ্বন্দ্ব চলছে চিরদিন, রাগে গরগর কথা, ফরফর রাতদিন।” — দোষের খতিয়ান। ‘একের মধ্যে তিন’। (১ম খণ্ড), ‘অর্ধেন্দুশেখর ভট্টাচার্য। ছেলে মেয়েদের ‘মানুষ’ করে তুলতে মা-বাবাদের ভাবনার শেষ নেই, চিন্তার অবধি নেই, দুশ্চিন্তার লেখাজোখা নেই।

কৈশোরের কিশলয় পর্ণে পরিণত হয় | বয়ঃসন্ধির সমস্যা | শিশুর মন ও শিক্ষা

এঁরা জানেন বোঝেন অনেক, নির্দেশ উপদেশ তথ্য সত্যাদি সংগ্রহ করেন প্রভূত। সন্তানের ভাল কে না চান? এই ভাল চাইতে, সন্তানের ভাল করতে এঁরা উর মাটি চুর করতেও পিছপা হন না। কষ্ট স্বীকার? ত্যাগ?— যা বলবেন তাই এঁরা করতে উন্মুখ। কিন্তু সব নদীর গতি যেমন সমুদ্রে বা হ্রদে তেমনি সকল মা-বাবার সব অভিযোগ-অনুযোগ- ফরিয়াদ গিয়ে ঠেকে সেই— ‘কথা শোনে না’-তে !

আবার শিশু-কিশোর-তরুণদের বলতে দিন দেখবেন ওদেরও সব কথার শেষ কথা সেই— বড়োরা ছোটদের কথা শোনেনা যে! মুশকিল এই যে ওদের আমরা বলতে দিই না, ওদের না-বলা কথায় কানও দিই না, ওদের অব্যক্ত যন্ত্রণার অনুচ্চার অভিমানে আমরা মনও দিই না। সময় নেই বলেই নয়; মনটিই আসলে নেই বলে। বড়োর চশমাখানা আমরা এমন শক্তপোক্ত করে নাকে লাগিয়ে রাখি, প্রায় সর্বক্ষণই, যে ওদের চশমায় ওদের মন মানসিকতাকে দেখার দৃষ্টিটাই আর খুঁজে পাই না।

আরও দেখুন:

Leave a Comment